আবদুল্লাহ ইবনু মাসউদ রাদিআল্লাহু আনহু

তখন সবেমাত্র মক্কায় নবুওয়াতের আত্মপ্রকাশ ঘটেছে।

আবদুল্লাহ ইবনু মাসউদ রাদিআল্লাহু আনহু তখন মক্কা নগরীর লোকালয় থেকে দূরে কুরাইশী সর্দার উকবা ইবনু আবু মুুআইতের বকরির পাল চড়াতেন।[১]

লোকেরা তাকে 'ইবনু উম্মে আবদ' বলে ডাকত।[২]

আল্লাহর নিয়ামতে তিনি নবিজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মুজিযা দেখে ঈমান আনেন।[৩]

তিনি যখন ইসলাম গ্রহন করেন তখন মক্কা নগরীতে ইসলামগ্রহনকারীদের সংখ্যা ছিল মুষ্টিমেয়। তখনো প্রকাশ্যে ইসলামের দাওয়াত চালু হয়নি।[৪]

তিনিই ছিলেন সর্বপ্রথম মুসলিম যিনি রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পর পৃথিবীর বুকে উচ্চ আওয়াজে কুরআন পড়েছেন। তিনি একদিন সাহস করে সাহাবায়ে কেরাম রাদিআল্লাহু আনহুমের আদেশ অমান্য করে মাসজিদুল হারামে ছুটে যান এবং কুরআন তিলাওয়াত শুরু করেন। মুশরিকরা তা দেখে তার দিকে ছুটে আসে এবং মারধর শুরু করে, এমনকি তার পুরো শরীর রক্তাক্ত হয়ে যায়!…[৫]

আবদুল্লাহ ইবনু মাসউদ রাদিআল্লাহু আনহু শারীরিকভাবে খর্বকায়, ক্ষীণকায় ও দুর্বল ছিলেন; কিন্তু জ্ঞানযোগ্যতা, মেধা, প্রজ্ঞা ও স্মৃতিশক্তিতে ছিলেন অদ্বিতীয়! রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হাদিসে তার ওজন আল্লাহর দাঁড়িপাল্লায় উহুদ পাহাড় থেকেও অধিক ভারী বলে উল্লেখ করেছেন।[৬]

শারীরিক দুর্বলতা সত্ত্বেও তিনি ছিলেন বীরবাহাদুর। বদর যুদ্ধসহ অধিকাংশ যুদ্ধে অংশগ্রহন করেছেন। ইসলামের সবচেয়ে বড় দুশমন আবু জাহল তার হাতেই নিহত হয়। [৭]

খুলাফায়ে রাশিদিনের যুগে তিনিই ছিলেন তার সমকালের কুরআন-বিষয়ক জ্ঞানের সবচেয়ে বড় আলিম। তিনি বলতেন,

'আমি কুরআন কারিমের সর্বাধিক জ্ঞানের-বাহক। যদি কেউ আমাকে জানাতে পারে যে, অমুকের কাছে আরও বেশি ইলম রয়েছে আর তার কাছে উটে চড়ে যাওয়া সম্ভব হয় তাহলে আমি অবশ্যই সেখানে হাজির হব।' [৮]

একথা তিনি অহংকার করে বলতেন না। বরং আবু মাসউদ বদরি রাদিআল্লাহু আনহুর মতো বয়স্ক সাহাবিরাও তার ব্যাপারে সাক্ষ্য দিয়ে বলতেন,
'রাসুল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পর কুরআন কারিমের তার (আবদুল্লাহ ইবনু মাসউদ রা.) চেয়ে বড় আলিম আর কেউ নন।' [৯]
রাসুল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার সম্পর্কে বলেছেন,
'যে ব্যক্তি কুরআন সেভাবে পড়তে চায় যেভাবে নাজিল হয়েছে, সে যেন ইবনু উম্মু আবদের [১০] মতো পড়ে।' [১১]
আবদুল্লাহ ইবনু মাসউদ রাদিআল্লাহু আনহু রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সেবায় নিজেকে এমনভাবে নিয়োজিত করে রাখতেন যে, মদিনায় নবাগত অতিথি সাহাবায়ে কেরাম রাদিআল্লাহু আনহুম তাকে নবী-পরিবারের সদস্য বলে মনে করতেন। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ব্যক্তিগত কাজগুলো তার দায়িত্বেই থাকত।[১২]

খুলাফায়ে রাশেদিনের যুগে:
আবু বকর রাদিআল্লাহু আনহুর শাসনামলে মুরতাদ ও বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধভিযান শুরু হলে বিভিন্ন সময় মদিনা মুনাওয়ারার নিরাপত্তার দায়িত্ব আবদুল্লাহ ইবনু মাসউদ রাদিআল্লাহু আনহুর কাছে অর্পন করেছেন।[১৩]

তার পাঠদানের আসরে আবদুল্লাহ ইবনু উমার, আবদুল্লাহ ইবনু আব্বাস, জাবির ইবনু আবদিল্লাহ, আনাস ইবনু মালিক রাদিআল্লাহু আনহুমেদর মত নওজোয়ান সাহাবিগন অংশগ্রহন করতেন। এমনকি আবু হুরায়রা ও আবু মুসা আশআরি রাদিআল্লাহু আনহুমাদের মতো প্রবীণ সাহাবায়ে কেরামও তার থেকে হাদিস সংগ্রহ করতেন।[১৪]

ইরাক বিজয়ের পর উমার রাদিয়াল্লাহু আনহু আবদুল্লাহ ইবনু মাসউদ রাদিআল্লাহু আনহুকে সেখানে শিক্ষক ও উজিরের দায়িত্ব দিয়ে প্রেরণ করেন।[১৫] কুফা নগরীতে আবদুল্লাহ ইবনু মাসউদ রাদিআল্লাহু আনহু প্রায় চৌদ্দ বছর অতিবাহিত করেন। সে যুগে কুফা নগরী ছিল মুসলিম জাহানের পূর্বাঞ্চলীয় প্রদেশগুলোর প্রশাসনিক কেন্দ্র।[১৬]

কুফা নগরীতে তার সবচেয়ে বড় অবদান ছিল কুরআন কারিমের তাফসির ও ইসলামি ফিকাহর প্রচার-প্রসার। তিনি এ অঞ্চলে বিচারপতির দায়িত্ব পালন করার পাশাপাশি এ দায়িত্বও সুষ্ঠুভাবে আঞ্জাম দিয়েছেন। তার থেকে সে যুগের বড়ো বড়ো তাবেয়ীগন ইলম অর্জন করেছেন। এদের মধ্যে আলকামা ইবনু কায়িস, মাসরুক, আল-আসওয়াদ, উবাইদা সালমানি, কায়িস ইবনু আবি হাজিম, জির ইবনু হুবাইশ ও তারেক ইবনু শিহাব রাহিমাহুমুল্লাহ উল্লেখযোগ্য। তারাই পরবর্তীতে কুফায় তাফসির ও ফিকাহশাস্ত্রের অভূতপূর্ব প্রসার ঘটিয়েছেন।[১৭]

হানাফি ফিকহের দলিল-প্রমানের ভান্ডারে খুলাফায়ে রাশেদিনের পর সবচেয়ে বেশি বর্ণনা আবদুল্লাহ ইবনু মাসউদ রাদিআল্লাহু আনহুর কাছ থেকে বর্ণিত।[১৮]

অবশেষে ৩২ হিজরিতে উসমান ইবনু আফফান রাদিয়াল্লাহু আনহু তাকে সেই পদ থেকে অব্যাহতি দিয়ে মদিনায় ডেকে আনেন। যেহেতু সে সময় তার বয়স ষাটের ঘর পেরিয়ে গিয়েছিল তাই অব্যাহতি দেয়াটা ছিল যৌক্তিক।[১৯]

তিনি কুফা থেকে আসার পথে উমরা করেন এবং মদিনায় আসার কিছুদিন পরই ইন্তেকাল করেন। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জুবাইর ইবনু আওয়াম রাদিআল্লাহু আনহুর সঙ্গে আবদুল্লাহ ইবনু মাসউদ রাদিআল্লাহু আনহুর মধ্যে দ্বীনি ভ্রতৃত্ববন্ধন গড়ে দিয়েছিলেন। তাই তাদের দু'জনের মধ্যে আপন ভাইয়ের চেয়েও গভীর সম্পর্ক ছিল। এমনকি আবদুল্লাহ ইবনু মাসউদ রাদিআল্লাহু আনহুর অসিয়ত অনুযায়ী পারিবারিক অভিভাবক এবং অর্থনৈতিক বিষয়াদির দায়িত্বে তাকে নিযুক্ত করে যান।[২০]

মৃত্যুর সময়ও তার জিহ্বা ছিল আল্লাহর যিকিরে সিক্ত এবং কুরআনের আয়াত তিলাওয়াতে সজীব ও প্রানবন্ত। তার জানাযার নামাজে বিরাট একদল মুসলিম শরীক হন -যাদের মধ্যে জুবাইর ইবনু আওয়াম রাদিআল্লাহু আনহুও ছিলেন। তাকে মসজিদে নববীর সন্নিকটবর্তী 'বাকী গোরস্থানে' দাফন করা হয়।[২১]

আলি রাদিআল্লাহু আনহু কুফা নগরীতে গমন করলে সেখানে আবদুল্লাহ ইবনু মাসউদ রাদিআল্লাহু আনহুর শিষ্যদের সাথে সাক্ষাত হয়। তিনি তাদের কাছে তাদের শিক্ষকের গুনাবলি সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে তার সামনে পুরো চিত্র তুলে ধরেন। আলি রাদিআল্লাহু তখন বলেন,
'তিনি আদতেই এমন ছিলেন; বরং এর চেয়ে শ্রেষ্ঠ ছিলেন। তিনি কুরআন পড়েছেন। তিনি হালালকে হালাল আর হারামকে হারাম জানতেন। তিনি দ্বীনের ফকিহ আর সুন্নতের আলিম ছিলেন।' [২২]
রাদিআল্লাহু আনহু। আল্লাহ তার উপর সন্তুষ্ট হোন।


সম্পাদনা: মুফতি তানজিল আরেফিন আদনান হাফি.
সংকলন: রিদওয়ান নাবিল
ছবি ডিজাইন: তানজিমুল ইসলাম ত্বহা

  • [১]সাহাবায়ে কেরামের ঈমানদীপ্ত জীবন, খ.১ পৃ.১৫৯
  • [২] মুসলিম উম্মাহর ইতিহাস বিশ্বকোষ, খ.২ পৃ.৫৩৮।
    তার মায়ের নাম ছিল 'উম্মে আবদ'। তাই তার সাথে সম্বন্ধিত করেই আবদুল্লাহ ইবনু মাসউদ রাদিআল্লাহু আনহুকে 'ইবনু উম্মে আবদ' নামে ডাকা হত।
  • [৩] সাহাবায়ে কেরামের ঈমানদীপ্ত জীবন, খ.১ পৃ.১৬০-১৬১;
    নবীজি সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বাচ্চা ছাগীর (যার এখনো বাচ্চা জন্ম দেয়নি) ওলান থেকে দুধ দোহন করেন!...
  • [৪] সিয়ারু আলামিন নুবালা: ১/৪৬৪ (আর রিসালাহ প্রকাশনী) [সূত্রে মুসলিম উম্মাহর ইতিহাস বিশ্বকোষ, খ.২ পৃ.৫৩৮]
  • [৫] উসদুল গাবাহ, তরজমাতু আবদিল্লাহ ইবনু মাসউদ রা. [সূত্রে প্রগুক্ত];
    সাহাবায়ে কেরামের ঈমানদীপ্ত জীবন, খ.১ পৃ.১৬৮-১৭০
  • [৬] মুসনাদু আহমাদ, হাদিস নং: ৯২০;
  • [৭] মুসনাদু আহমাদ, হাদিস নং: ১২৪৭৭; দালায়িলুন নবুওয়্যাতি লিল বাইহাকি: ৩/৮৬ [সূত্রে মুসলিম উম্মাহর ইতিহাস বিশ্বকোষ, খ.২ পৃ.৫৪০]
    মূলত আবু জাহলকে কয়েকজন আনসারি যুবক মারাত্মক আহত অবস্থায় রেখে দিয়েছিল। নবীজি সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নির্দেশে আবদুল্লাহ ইবনু মাসউদ রাদিয়াল্লাহু আনহু তার সন্ধান করেন এবং গলা কেঁটে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে পেশ করেন। [প্রাগুক্ত]
  • [৮] সহিহ মুসলিম, হাদিস নং: ৬৪৮৬
  • [৯] সহিহ মুসলিম, হাদিস নং: ৬৪৮৪
  • [১০] ২ নং টীকা দ্রষ্টব্য।
  • [১১] সুনানে ইবনি মাজাহ, হাদিস নং: ১৩৮;
  • [১২] তারিখু খলিফা, ১১ হিজরি শিরোনামের অধীনে।[সূত্রে মুসলিম উম্মাহর ইতিহাস বিশ্বকোষ, খ.২ পৃ.৫৪২]
  • [১৩] সিয়ারু আলামিন নুবালা: ১/৪৬১, (আর রিসালাহ প্রকাশনী) [সূত্রে প্রাগুক্ত]
    আরও জানতে দেখুন: আবু বকর রাদিআল্লাহু আনহুর বিদ্রোহীদের দমন।
  • [১৪] কিতাবুল আসার, লিল কাজি আবি ইউসুফ: ১৩৩, (আল-ইলমিয়্যা প্রকাশনী);
    তবাকাতু ইবনি সা'দ: ৩/৫৬, (দারু সাদির প্রকাশনী)
    [সূত্রে প্রাগুক্ত, পৃ.৫৪৩]
  • [১৫] আল-ইসাবাহ: ৪/২০১, (আল-ইলমিয়্যাহ সংস্করণ)
    [সূত্রে প্রাগুক্ত, পৃ.৫৪৪]
  • [১৬] মুসলিম উম্মাহর ইতিহাস বিশ্বকোষ, খ.২ পৃ.৫৪৪
    কুফা নগরী সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে দেখুন:
    কুফা নগরীর গোড়াপত্তন।
  • [১৭] সিয়ারু আলামিন নুবালা: ১/৪৬১, ৪৬২ (আর রিসালাহ প্রকাশনী)
    [সূত্রে মুসলিম উম্মাহর ইতিহাস বিশ্বকোষ, খ.২ পৃ.৫৪৪]
  • [১৮] মুসলিম উম্মাহর ইতিহাস বিশ্বকোষ, খ.২ পৃ.৫৪২
  • [১৯] তাকে অপসারণ সম্পর্কিত অনেকগুলো বর্ণনার মাঝে উসমান রাদিআল্লাহু আনহু সহ কয়েকজন সাহাবির সঙ্গে সম্পর্কের টানাপড়েনের কথা বলা হয়েছে। কিন্তু সবগুলো বর্ণনাই সনদের বিচারে দুর্বল ও অগ্রহনযোগ্য।
    দেখুন: মুসলিম উম্মাহর ইতিহাস বিশ্বকোষ, খ.২ পৃ.৫৪৫
  • [২০] সিয়ারু আলামিন নুবালা: ১/৪৯৮ (আর রিসালাহ প্রকাশনী) [সূত্রে প্রাগুক্ত, পৃ.৫৪৫]
  • [২১] সাহাবায়ে কেরামের ঈমানদীপ্ত জীবন, খ.১ পৃ.১৭১
  • [২২] তাবকাতু ইবনি সা'দ: ৩/১৫৬ (সাদির প্রকাশনী)
    [সূত্রে মুসলিম উম্মাহর ইতিহাস বিশ্বকোষ, খ.২ পৃ.৫৪৬]